বাংলা ভাষার বিশ্ব পরিক্রমা
আদি বাংলা একদা চর্যাপদের খোলসে নেপাল হয়ে তিব্বত পরিভ্রমণ করেছিল। লাসায় ব্যাপক চর্যাপদ চর্চা হয়েছিল তার প্রমাণ এখনো বিলুপ্ত হয়নি। মধ্যযুগে বাঙালি ব্যবসায়ী নাবিক প্রমুখের সাথে বাংলা ভাষা দূরপ্রাচ্যেও বিস্তার লাভ করেছিল।
একবার জাকার্তায় এক সম্মেলনে গিয়ে এক যুবক রুমমেট পেলাম। নাম জিজ্ঞেস করে জানলাম : ‘সুরিয়া সুরিয়া’। অর্থ কী? ও বলল : এটা তো তোমাদের ভাষার শব্দ। কী করে? সুরিয়া মানে সূর্য! ও, তাহলে তুমি হচ্ছ ডবল সূর্য! এর আগে লেবাননে এক সাংবাদিক পেয়েছিলাম, যার নাম খায়রাল্লাহ, খায়রাল্লাহ- আমরা বলতাম ‘ডবল খায়রাল্লাহ’! যাক, দূরপ্রাচ্যে সংস্কৃতের সঙ্গে বেশ কিছু বাংলা শব্দ ও সাংস্কৃতিক পরিচিতির নিদর্শন ঢুকে একাত্ম হয়ে আছে। আরাকানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার ইতিবৃত্ত সুবিদিত।
সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলা গদ্য চর্চার সূত্রপাত ঘটল পর্তুগিজ পাদ্রিদের হাতে। একটা অসাধারণ কাজ করলেন পাদ্রি মানোএল দা আসাম্পসাঁও। তিনি ঢাকার অদূরে ভাওয়াল নগরীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে বাংলা ভাষায় প্রথম ব্যাকরণ এবং আদি ও একমাত্র বাংলা-পর্তুগিজ, পর্তুগিজ-বাংলা অভিধান সঙ্কলন করলেন। বহু বাধা-বিপত্তির মধ্যেও ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে লিসবন শহর থেকে প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার মহাগ্রন্থটি প্রকাশ করলেন। পরম করুণাময়ের বিশেষ অনুগ্রহে নভেম্বর ২০১৫ সালে আমি পর্তুগালের এভোরা শহর (মানোএলের জন্ম ওই শহরে) থেকে পাণ্ডুলিপির ডিজিটাল ফটোকপি করে আনতে সমর্থ হই। বলা বাহুল্য, এর কয়েক দশক পর ফরাসি ও ইংরেজ ভাষাবিদরা ব্যাকরণ ও শব্দকোষ নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে পাশ্চাত্যে ফিললজি তথা ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব চর্চার ধুম পড়ে যায়। সে সময় থেকে কোথাও কোথাও বাংলা নিয়ে আগ্রহও পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু যথার্থভাবে কাজ শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যভাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে যোগদানের পর থেকে। প্রাচ্যের জনভাষাগুলোর ব্যাপক চর্চা তখন শুরু হয়।
খ্যাতনামা ভাষাবিদ ফার্গুসনের কথা আমরা শুনেছি। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সাহচর্যে তিনি পূর্ববাংলার কথ্য ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন। বাংলা ফনিমের ওপরও গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার অনুসরণে প্রফেসর ডিমক এবং ড. ক্লিন্ট সিলি প্রমুখ শিকাগোতে বাংলা পঠন-পাঠনের ব্যাপক ব্যবস্থা করেন। ১৯৬০-এর গোড়ার দিকে নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহফুজুল হক বেশ কয়েক সেমিস্টার বাংলা পড়ান। কানাডার টরন্টো শহরে দীর্ঘদিন ড. জোসেফ টি. ও কনেল ও তার স্ত্রী ক্যাথলিনের আন্তরিক প্রয়াসের কথা বিস্মৃত হওয়া যায় না। অন্যদিকে লন্ডন অধ্যাপক ক্লার্ক ও বোলটনের আগ্রহে ও চেষ্টায় আমাদের দেশী গবেষকদের পরিশ্রমে বাংলা চর্চার বড় কেন্দ্ররূপে গড়ে ওঠে।
এ দিকে প্যারিসে ১৯৬১ থেকে কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ ও আমি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করি, যাতে সেখানে বাংলা চালু হয়। জিল ফিলিবের নামে এক উৎসাহী ভাষাবিদ পাওয়া গেল। তার অধীনে প্রভাষকরূপে এই প্রবন্ধ লেখক চার বছর বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক পাঠদানে নিয়োজিত থাকেন। পরে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কেউ বাদ দিতে চাইলে ফরাসি মনীষী ও সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী অঁদ্রে মালরোর দোভাষী হওয়ার সুবাদে তাকে দিয়ে আমি তদবির করি যাতে এটা বন্ধ না হয়। সৌভাগ্যক্রমে সেটি বন্ধ হয়নি। ড. ফ্রঁস ভট্টাচার্য ও তার ছাত্ররা পরে সেখানে হাল ধরেছেন। কিছুটা উন্নতমানের পাঠক্রমও এখন সেখানে শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
অন্যত্র সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৫ সালে তিন মাসের জন্য ভ্রাম্যমাণ অধ্যাপকের পদমর্যাদায় আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দুটি কোর্স প্রদান করি। বর্তমানে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে বাংলা ভাষায় বিশ্বপরিক্রমা অব্যাহত রয়েছে। আশির দশকের শেষ দিকে সংস্কৃতি কমিশনের রিপোর্টে জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের নেতৃত্বে আমরা বিশ্বের কয়েকটি শহরে আমাদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাংলা চর্চার ব্যবস্থা রাখার উল্লেখ করি। এককালে (৬০-৭০ দশকে) ইউনেস্কো থেকে বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি নিদর্শন প্রকাশিত হয়েছিল। যথা সোজন বাদিয়ার ঘাট (জসীমউদদীন), লাল সালু (সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ), পথের পাঁচালী (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রভৃতি।
দুর্ভাগ্যবশত, সে প্রোগ্রাম এখন বন্ধ। গত বছর আমি ইউনেস্কোতে গিয়ে প্রকাশনা প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছি। কিন্তু আপাতত কিছু করার উপায় নেই। তবে এখন ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠনিক উৎসাহ-উদ্দীপনায় দেশে-বিদেশে ভাষাচর্চা ও প্রকাশনায় কিছু সুলক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য সুখবর বটে!
একবার জাকার্তায় এক সম্মেলনে গিয়ে এক যুবক রুমমেট পেলাম। নাম জিজ্ঞেস করে জানলাম : ‘সুরিয়া সুরিয়া’। অর্থ কী? ও বলল : এটা তো তোমাদের ভাষার শব্দ। কী করে? সুরিয়া মানে সূর্য! ও, তাহলে তুমি হচ্ছ ডবল সূর্য! এর আগে লেবাননে এক সাংবাদিক পেয়েছিলাম, যার নাম খায়রাল্লাহ, খায়রাল্লাহ- আমরা বলতাম ‘ডবল খায়রাল্লাহ’! যাক, দূরপ্রাচ্যে সংস্কৃতের সঙ্গে বেশ কিছু বাংলা শব্দ ও সাংস্কৃতিক পরিচিতির নিদর্শন ঢুকে একাত্ম হয়ে আছে। আরাকানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার ইতিবৃত্ত সুবিদিত।
সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলা গদ্য চর্চার সূত্রপাত ঘটল পর্তুগিজ পাদ্রিদের হাতে। একটা অসাধারণ কাজ করলেন পাদ্রি মানোএল দা আসাম্পসাঁও। তিনি ঢাকার অদূরে ভাওয়াল নগরীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে বাংলা ভাষায় প্রথম ব্যাকরণ এবং আদি ও একমাত্র বাংলা-পর্তুগিজ, পর্তুগিজ-বাংলা অভিধান সঙ্কলন করলেন। বহু বাধা-বিপত্তির মধ্যেও ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে লিসবন শহর থেকে প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার মহাগ্রন্থটি প্রকাশ করলেন। পরম করুণাময়ের বিশেষ অনুগ্রহে নভেম্বর ২০১৫ সালে আমি পর্তুগালের এভোরা শহর (মানোএলের জন্ম ওই শহরে) থেকে পাণ্ডুলিপির ডিজিটাল ফটোকপি করে আনতে সমর্থ হই। বলা বাহুল্য, এর কয়েক দশক পর ফরাসি ও ইংরেজ ভাষাবিদরা ব্যাকরণ ও শব্দকোষ নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে পাশ্চাত্যে ফিললজি তথা ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব চর্চার ধুম পড়ে যায়। সে সময় থেকে কোথাও কোথাও বাংলা নিয়ে আগ্রহও পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু যথার্থভাবে কাজ শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যভাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে যোগদানের পর থেকে। প্রাচ্যের জনভাষাগুলোর ব্যাপক চর্চা তখন শুরু হয়।
খ্যাতনামা ভাষাবিদ ফার্গুসনের কথা আমরা শুনেছি। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সাহচর্যে তিনি পূর্ববাংলার কথ্য ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন। বাংলা ফনিমের ওপরও গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার অনুসরণে প্রফেসর ডিমক এবং ড. ক্লিন্ট সিলি প্রমুখ শিকাগোতে বাংলা পঠন-পাঠনের ব্যাপক ব্যবস্থা করেন। ১৯৬০-এর গোড়ার দিকে নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহফুজুল হক বেশ কয়েক সেমিস্টার বাংলা পড়ান। কানাডার টরন্টো শহরে দীর্ঘদিন ড. জোসেফ টি. ও কনেল ও তার স্ত্রী ক্যাথলিনের আন্তরিক প্রয়াসের কথা বিস্মৃত হওয়া যায় না। অন্যদিকে লন্ডন অধ্যাপক ক্লার্ক ও বোলটনের আগ্রহে ও চেষ্টায় আমাদের দেশী গবেষকদের পরিশ্রমে বাংলা চর্চার বড় কেন্দ্ররূপে গড়ে ওঠে।
এ দিকে প্যারিসে ১৯৬১ থেকে কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ ও আমি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করি, যাতে সেখানে বাংলা চালু হয়। জিল ফিলিবের নামে এক উৎসাহী ভাষাবিদ পাওয়া গেল। তার অধীনে প্রভাষকরূপে এই প্রবন্ধ লেখক চার বছর বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক পাঠদানে নিয়োজিত থাকেন। পরে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কেউ বাদ দিতে চাইলে ফরাসি মনীষী ও সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী অঁদ্রে মালরোর দোভাষী হওয়ার সুবাদে তাকে দিয়ে আমি তদবির করি যাতে এটা বন্ধ না হয়। সৌভাগ্যক্রমে সেটি বন্ধ হয়নি। ড. ফ্রঁস ভট্টাচার্য ও তার ছাত্ররা পরে সেখানে হাল ধরেছেন। কিছুটা উন্নতমানের পাঠক্রমও এখন সেখানে শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
অন্যত্র সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৫ সালে তিন মাসের জন্য ভ্রাম্যমাণ অধ্যাপকের পদমর্যাদায় আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দুটি কোর্স প্রদান করি। বর্তমানে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে বাংলা ভাষায় বিশ্বপরিক্রমা অব্যাহত রয়েছে। আশির দশকের শেষ দিকে সংস্কৃতি কমিশনের রিপোর্টে জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের নেতৃত্বে আমরা বিশ্বের কয়েকটি শহরে আমাদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাংলা চর্চার ব্যবস্থা রাখার উল্লেখ করি। এককালে (৬০-৭০ দশকে) ইউনেস্কো থেকে বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি নিদর্শন প্রকাশিত হয়েছিল। যথা সোজন বাদিয়ার ঘাট (জসীমউদদীন), লাল সালু (সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ), পথের পাঁচালী (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রভৃতি।
দুর্ভাগ্যবশত, সে প্রোগ্রাম এখন বন্ধ। গত বছর আমি ইউনেস্কোতে গিয়ে প্রকাশনা প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছি। কিন্তু আপাতত কিছু করার উপায় নেই। তবে এখন ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠনিক উৎসাহ-উদ্দীপনায় দেশে-বিদেশে ভাষাচর্চা ও প্রকাশনায় কিছু সুলক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য সুখবর বটে!
No comments